মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী
বীর মুক্তিযোদ্ধা
মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন
যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই। যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই! তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা। গানের কথাগুলো শুনলেই চোখ ভিজে আসে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা শুধু বাংলায় কেন এই গোটা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই যিনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি দিনের পর দিন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন স্বাধীনতার জন্য এবং সত্যি সত্যি তিনি সেই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
আগস্ট। বাঙালি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত বেদনা বিধুর, অশ্রু ঝরানো, শোকাবহ মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতি হারিয়েছে তার অমূল্য রতন। সেদিনের কিছু স্মৃতিকথা আজ আমি নতুন প্রজন্মের জন্য এখানে তুলে ধরতে চাই। ‘বাংলাদেশ জাতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন’-এর ব্যানারে চট্টগ্রামে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। স্থানীয় মুসলিম হলে ১৭ আগস্ট হতে ১৯ আগস্ট তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন হবে ঠিক হলো। তপন বৈদ্য ছিলেন এ সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক আর আমি (মো. রেজাউল করিম চৌধুরী) ছিলাম যুগ্ম আহ্বায়ক। ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকেরই এ সম্মেলনে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মণি ভাই এ ব্যাপারে আমাদেরকে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। কথা ছিল, সম্মেলনের প্রত্যেক দিন একটি করে তিন দিনে মোট তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। আর, নাটক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। জাতীয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার উন্নয়নে জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। আমাদের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধক হিসেবে আমরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শেখ কামাল সাহেবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।
১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই, তার সঙ্গে আমাদের সম্মেলন প্রস্তুতির নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি আমাদেরকে সম্মেলনের খরচের জন্য ৫০০০ টাকা দেন এবং রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এরপর আমরা তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাদেরকে পরদিন সকালে তার বাসায় যেতে বলেন। সব শেষে আমরা ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক নুরুল ইসলামের বাসায় যাই। কাশেম চিশতিও সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ঐ রাতেই ১১টার সময় নুরুল ইসলামের বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে আমরা সম্মেলনের উদ্বোধক বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল ভাইয়ের সাথে কথা বলি। তিনি ১৭ তারিখে আমাদের সম্মেলনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করার ব্যাপারে আমাদেরকে শতভাগ আশ্বাস প্রদান করেন। নুরুল ইসলামের নন্দনকানস্থ বাসা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে পৌঁছাই যখন, তখন রাত ১টা। বেশকিছু কুকুর একসঙ্গে কান্নার রোল তুলে ডাকছিল। মনটা কেমন যেন মোচর দিয়ে উঠল, কেমন যেন বিষণœতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল শরীর মন। তা ছাড়া মুরব্বীদের মুখে শুনেছি, কুকুরের কান্না নাকি অশুভ লক্ষণ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তপন বৈদ্য বলল দেশে কোথায় কোন অঘটন ঘটতে চলেছে কে জানে? কুকুরগুলো এভাবে কান্না করছে কেন? আমি সান্ত¦না দিয়ে বললাম, ওসব কিছুই না। এগুলো সব মুরব্বীদের বলা কুসংস্কার। তারপর আমরা ঘুমোতে যাই। সকালে ওঠে ডিসির বাসায় যাব, খুব ভোরে লেয়াকত নামে জাসদ সমর্থক এক ছাত্র আমাকে জানাল, বঙ্গবন্ধুকে নাকি ভোরবেলায় হত্যা করা হয়েছে। আরেকটু পর আরেক ছাত্রনেতা গোলাম মোহাম্মদও একই কথা বলল। আমি তাদের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্যারেড কর্ণারের পূর্ব পাশে খালেকের বাসায় গিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠালাম। বললাম, তোমার রেডিওটা অন করো। রেডিও অন করতেই খুনিদের ঘোষণা শুনতে পেলাম। তবুও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, সব কিছুই স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার। নিজে এবং সবাইকে শান্ত থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আমরা দ্রুত মতিন বিল্ডিংয়ের ছাত্রলীগের অফিসে গেলাম তখন সকাল ৯টা। সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সরফরাজ খান বাবুল, সন্দ্বীপের রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ির আনোয়ারুল আজিম, শওকত হোসেন, মান্নান, ইসমাইল, কাশেম চিশতী, পটিয়ার এমএ জাফর, শামসুজ্জামানসহ বিশ পঁচিশজন ছাত্রনেতাকে একসঙ্গে পেলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করার। তৎক্ষণাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কে সি দে রোড, টিঅ্যান্ডটি অফিস, লালদীঘি হয়ে রেয়াজ উদ্দীন বাজার আমতল, তিনপুলের মাথা হতে ঘুরে শহীদ মিনার হয়ে আবারও পার্টি অফিসে আসি। কোথাও কোনো বাধা পাইনি। রাস্তায় তেমন কোনো মানুষজন কিংবা পুলিশও ছিল না। সবদিকে কেমন জানি সুনসান নীরবতা।
তপন বৈদ্যের বাসা ছিল ফকিরহাট। মিছিলের পর আমরা তার বাসায় যাওয়ার পথে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনের সামনে নামলাম এবং স্টেশনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বক্তব্য রাখার সুযোগ চাইলাম। রেডিও কর্তৃপক্ষ রাজি হলেন না। তারপর তপন বৈদ্যের বাসায় চলে যাই। বাকশাল সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে জেলা গভর্নদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য নেতাদের প্রায় সবাই ঢাকায় ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সব যোগাযোগ মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিকালে আমরা আবারও বেরিয়ে পড়ি। মুক্তিযোদ্ধা চেঙ্গিস খানের শ্বশুরের কাজীর দেউড়িস্থ বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কজন কথা বলছিলাম। বিকাল ৫টার দিকে দেখলাম সামরিক বাহিনীর কিছু গাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পথচারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে।
আমরা রাস্তার পাশ ছেড়ে কিছুটা ভেতরে গলির দিকে ঢুকে পড়লাম। আমাদের মধ্যে কাশেম চিশতীর বাসা ছিল চাক্তাই। আমরা সবাই যে যার বাসায় চলে গেলাম। ১৭ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেল থেকে রাউজানের সালাম ও বাবুল আমাদের বহরদার বাড়ির বাসায় আসে। পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আলোচনা করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মী ও কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে লাগলাম।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসএম ইউসুফ ভাই (মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর জেলা প্রধান) একদিন রাতে আমার বাসায় আসলেন মজিদের মোটর সাইকেলে চড়ে, বললেন চল বাইরে যাব। মাকে বলে বেরিয়ে পড়লাম (মা অবশ্য বাধা দিয়েছিলেন, তবুও) দুজনেই। ইউসুফ ভাই আমাকে জামালখানস্থ নজরুলের বাসায় রেখে কোথায় জানি চলে গেলেন। সেই রাতে নজরুলের বাসায় রয়ে গেলাম। সকালে সাতকানিয়ার মুনিরের মারফত ইউসুফ ভাই খবর পাঠালেন। বললেন, তিনি আসবেন। সারা দিন অপেক্ষায় ছিলাম, রাত ১০টার দিকে আবারও মনির এসে আমাকে তার সঙ্গে বের হতে বললেন। বললেন, ইউসুফ ভাই আমাদের জন্য অভয় মিত্র ঘাটে অপেক্ষা করছেন। অভয় মিত্র ঘাটের একটি ফিশিং বোটে আনোয়ারুল আজিম, গোলাম রাব্বানী, মো. সেলিম, শওকত হোসেন, রফিক, মনির, কাজী আবু তৈয়ব, মহিউদ্দিন রাশেদ, শামসুজ্জামান, জাফর, দেলোয়ার, মান্নানসহ আমরা ১৪ জন ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। ইউসুফ ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে করণীয় সম্পর্কে আমাদের উদ্দেশে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন এবং যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এ বৈঠকের ঠিক ১৫ দিন পর আমরা নিউমার্কেট মোড়, আগ্রাবাদ, কাজীর দেউরীসহ চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি জায়গায় গ্রেনেড চার্জ করি। এরপর ইউসুফ ভাইসহ কাজী আবু তৈয়ব ও আমি আমাদের নেতা মান্নান ভাইয়ের বাসায় যাই।
শক্তি সংগ্রহের জন্য ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে মান্নান ভাইকে বুঝিয়ে বলি। মান্নান ভাই এতে রাজি হলেন না। কিন্তু ইউসুফ ভাই ঠিকই ভারতে চলে গেলেন। এদিকে কঠোর বিধিনিষেধের জাঁতাকলে পড়ে কোথাও জড়ো হওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ল। তখন নিউমার্কেটে নজরুলের শাহ আমানত স্টোর হয়ে উঠল আমাদের যোগাযোগের অন্যতম ক্ষেত্র। এখানে আমরা ক্রেতাবেশে আসতাম এবং পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করব।
ছাপানোর দায়িত্ব ছিল ফটিকছড়ির এসএম ফারুকের ওপর। যথারীতি লিফলেট ছাপানো হলো, বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হলো। এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে আমরা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকলাম। নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ আমরা জানতে পারলাম, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে কারাগারের ভেতর ঢুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা নুরুল বশর ও আমি আমাদের বহরদার বাড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে কাজেম আলী স্কুলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে লিয়াকত (পরবর্তীতে কমিশনার) ও আওয়ামী লীগ কর্মী ফোরক আহমদের সঙ্গে দেখা হয়। ৪ জন মিলে আলাপ করলাম কী করা যায়! লিয়াকত বলল, চল আমরা চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে প্রতিবাদী মিছিল বের করি। যদিও আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই ১৯৭২ সালে, সম্মেলন না হওয়ায় তখনও আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে আছি। আমরা কয়েকজন দ্রুত কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাম আর গ্যালারি-২ এ গিয়ে বললাম ক্লাস হবে না। শিক্ষক আবু তাহের তা মানতে রাজি হলেন না। লিয়াকত ক্যাম্পাসের এদিক সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে, একজন ছাত্র ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে আয়নায় সজোরে একটি পাথর ছুড়ে মারল। বিকট আওয়াজ আর কাচ ভাঙার শব্দ শুনে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা দিগবিদিগ ছুটতে আরম্ভ করল। তারপর, প্রতিবাদী ছাত্রদের নিয়ে আমরা মিছিল বের করি এবং মহসীন কলেজ, কাজেম আলী স্কুল ও খাস্তগীর স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে দিই।
এরপর মিছিল নিয়ে আন্দরকিল্লা, নজির আহমদ সড়ক, রাইফেল ক্লাব হয়ে শহীদ মিনারে দিকে ঘুরতেই নিউমার্কেটের ওইদিক থেকে পুলিশ ও বিডিআর সদস্যদের কয়েকটি গাড়ি এসে আমাদের ওপর হামলে পড়ে। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তৎকালীন গ্র্যান্ড হোটেলের গলিতে ঢুকে যাওয়ার পরও দেখি পুলিশ আমার পিছু ছাড়েনি। পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের সীমানা প্রাচীর টপকে আমি কোনো প্রকারে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হলেও অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। রাঙ্গুনিয়ার এমপি মরহুম ক্যাপ্টেন কাশেমের একান্ত সহযোগিতায় পরের দিনই গ্রেফতারকৃতরা তারা ছাড়া পান। সেদিন বিকালেই ইউনাইটেড হোটেলের সামনে সিটি কলেজের ছাত্রনেতা জানে আলমের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। হোটেলের কাছেই জানে আলমের বাসা। হোটেল মালিকের শ্যালক যখন বললেন, কক্সবাজারের গোলাম রাব্বান ভাই হোটেলে আছেন তখন আমরা হোটেলের এক কোনার গোপন আস্তানায় তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, আমরা সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের করব তোমরা দ্রুত প্রস্তুতি নাও। চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেলে এসে বেয়ারা বশরকে ৫০ টাকা দিয়ে বাঁশ, চট ও কেরোসিন এনে মশাল তৈরী করতে বললাম। বিকাল ৩টায় হোস্টেলের আরেক বেয়ারা চিত্ত এসে বলল মশালের সরঞ্জামসহ বশর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আমাদের মশাল মিছিলের পরিকল্পনা এখানে ব্যর্থ হলো। এরপর রাব্বান ভাইসহ আমরা পরের দিন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফেনীর গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তার একটা ছাপাখানা ছিল এনায়েত বাজারে। সেখান থেকে গোপনে হরতালের সমর্থনে লিফলেট ছাপানো হলো। সারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ওই লিফলেট বিতরণ করা হলো। মুত্তিযোদ্ধা নুরুল বশর ও আমি বহরদার হাট, মুরাদপুর, চকবাজার, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও এলাকার দায়িত্ব নিয়ে লিফলেট বিতরণ করি। হরতাল হয়নি, পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না সেটা তো বুঝতেই পারছেন। আমরা বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি দিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে আস্তে আস্তে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছিলাম মাত্র। জাতির সেই চরম সংকট-সন্ধিক্ষণেও বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম জেগে ওঠে দুর্দমনীয় প্রতিরোধের সংকল্পে। অমানিশার অন্ধকারে যখন ঢেকে গিয়েছিলো দিগবলয়, ভোরের প্রত্যাশায় রাত্রির তপস্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিলো, তখন চট্টগ্রামের বীরসন্তানরা এভাবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল। চট্টগ্রামের বিদ্রোহের জন্য তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে তিনটি মামলাকে একত্রিত করে একটি চার্জশিট দেয়া হয়। সরকার পক্ষ মামলাটির নামকরণ করে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’। সেদিনের কথা মনে হলে আজও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এদেশের একদল মানুষ বুকের মধ্যে সযত্নে বঙ্গবন্ধুকে লালন করেছেন। আসলে বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার তো আসল মৃত্যু নেই। আজ শোকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুসহ নিহত সবাইকে। আসলে যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু। আর সে কারণেই বাঙালি কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাগুলো বলতে হয়- যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.