কর্ণফুলীতে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প বন্ধ না করলে চসিক ঘেরাও
আগামি পাঁচ দিনের মধ্যে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে বাকলিয়া দ্বীপে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প স্থাপন বন্ধের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যতায় আগামি ২৭ মে সিটি কর্পোরেশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হবে। সেই সাথে উচ্চ আদালতে নির্দেশ অমান্য করাসহ সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিকার প্রার্থনা করে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান ও হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করা হবে।
বুধবার (২২ মে ) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আলটিমেটাম দেয়া হয়। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলা, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র, আরএসকে ফাউন্ডেশন,কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন, গ্রিন ফিঙ্গার্স ফাউন্ডেশন, তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ এর যৌথ উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে প্রকল্প হয় জনস্বার্থে নয় কতিপয় মানুষের পকেট ভারী করতে। বাকলিয়া দ্বীপে বর্জ্য শোধণাগারও এর ব্যতিক্রম নয়। নদীর মাঝখানে চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য নিয়ে নদী হত্যার পরিকল্পনা সুস্থ মানুষের মাথায় কি করে আসে। এখন ভদ্রভাবে দাবী জানাচ্ছি। আপনারা মেনে যান না হয় সর্বস্তরের জনগণ রাস্তার আন্দোলনে নেমে আপনাদের এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদ বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি বর্জ্যশোধনাগার প্ল্যান্ট করতে হবে। তবে কর্ণফুলী নদীর মাঝ খানে চরের মধ্যে নয়। তিনি আশংকা করে বলেন, এ চরের মধ্যে বর্জ্য প্ল্যান্ট করা হলে, নদী ধ্বংসের শেষ পেরেকটি টুকে দেয়া হবে। তিনি এ বর্জ্যপ্ল্যান্ট স্থলভাগে হালিশহর আনন্দবাজার এলাকার সিটি করপোরেশন ডাম্পিং স্টেশনে অথবা জঙ্গল ছলিমপুরে ডাম্পিং স্টেশনে অথবা শহরের যেকোনো জায়গায় পরিবেশ রক্ষা করে স্থলভাগে বর্জ্যশোধনাগার প্ল্যান্ট নির্মাণ করার দাবি জানান।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান লিখিত বক্তব্য ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মহামান্য হাইকোর্টের “আদালতের রায়ে আমাদের দেশের নদীগুলোকেও জীবন্ত সত্তা, জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং মূলত এর মাধ্যমে মানুষের মত নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প করা অবৈধ এবং আদালতের আদেশের লঙ্ঘন করে। সুতারাং এই প্রকল্প হতে পারে না।
বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ১৮ক) বলছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ তার মানে জলাভূমি অর্থাৎ নদীর নিরাপত্তা বিধান সংবিধানস্বীকৃত এবং সেটি সেটি করতে হবে স্বয়ং রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র মানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। যে কারণে ২০১৯ সালে হাইকোর্ট যখন একটি রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেন, তখন নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়-যারা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে নদীমাতার অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু এই প্রকল্প নদীর অধিকারকে হত্যা করবে। দেশের সংবিধান অনুযায়ী নদীর মাঝখানে বর্জ্য শোধণাগার প্রকল্প করা থেকে সরে আসতে হবে।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরে বন্দরনগরী ভিত্তিক পরিবেশ সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন(ইসিএইচও) এর সহযোগিতায় কর্ণফুলী নদীর প্রাণ প্রকৃতি, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও দূষণ নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। দূষণ রোধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে আরও ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৫৩টি শিল্পসহ ৮৯টি উৎস থেকে কর্ণফুলী নদী দূষিত হচ্ছে। গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে।
উপরোক্ত গবেষণা তথ্য মতে কর্ণফুলীর তীর থেকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা ৮১ প্রজাতির দেশীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ করে নাসারিতে বিকাশিত করে সামানের বর্ষা মৌসুমে এই চরে লাগানো হোক। এতে কর্ণফুলী নদী প্রাণ ফিরে পাবে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে মানুষের বিনোদনের কোন স্থান নাই। পৃথিবীতে অনেক দেশে নদী বা সাগরের মাঝখানের চরে নান্দনিক পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করে দেশি বিদেশি পর্যটক দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছে। এই চরটি পরিবেশ বান্ধন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি ইকো ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলা হোক। এতে করে কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষার পাশাপাশি চট্টগ্রামের ও দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, রাজনীতিবিদ ও পরিবেশ সংগঠক মিঠুল দাশ গুপ্ত, পরিবেশ সংগঠক ডাক্তার মঞ্জুরুল করিম বিপ্লব, নারী নেত্রী ও পরিবেশ সংগঠক হাসিনা আক্তার টুনু, চট্টগ্রাম মহানগর যুব লীগের সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারশন সভাপতি এস এম পেয়ার আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও পরিবেশ সংগঠক এম শাহাদাৎ নবী খোকা, চট্টগ্রাম জেলা নৌযান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন সভাপতি এম.নুরুল হুদা চৌধুরী, এইচ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান শাহিন শিরিন, আর এস কে ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী জাহেদুল করিম শিকদার, সাবেক ছাত্রনেতা জাফর আল তানিয়ার, বাশখালী নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন সভাপতি মো. আজগর হোসেন তালুকদার, পতেঙ্গা নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়ন সভাপতি মো. হাছান বাদশা প্রমুখ।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.