সাহাবুদ্দিনই একমাত্র প্রার্থী, রাষ্ট্রপতি হতে বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সব কিছু ঠিক থাকলে তিনি হবেন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন আজ রবিবার (১২ ফেব্রুয়ারি)। এদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে নির্বাচন কর্মকর্তার (সিইসি) দফতরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। দুপুরে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পক্ষেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সে দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে যেহেতু আর কোনও প্রার্থী নেই, তাই ভোট প্রয়োজন হবে না। এখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা শুধু বাকি। সেক্ষেত্রে একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। আর একাধিক প্রার্থী থাকলে তফসিল অনুযায়ী, সংসদের অধিবেশন কক্ষে ভোট অনুষ্ঠিত হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেন সংসদ সদস্যরাই। সেক্ষেত্রেও জাতীয় সংসদের ৩৫০টি আসনের সংসদে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা এখন ৩০৫। তাই এ কথা নিশ্চিতভাবে বলাই যায়, টানা দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পর বঙ্গভবনের বাসিন্দা হতে যাচ্ছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনই।
পেশায় আইনজীবী সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বাড়ি পাবনায়। রাষ্ট্রপতি পদে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্রের তথ্য অনুযায়ী, তার হোল্ডিং নম্বর ৮৮/১, শিবরামপুর, সদর, পাবনা। ঢাকায় তিনি থাকেন গুলশানে। তিনি ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির পথচলায় চুপ্পু দীর্ঘদিন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি পরে যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৪ সালে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তার প্রতিবাদ জানান তিনি। সে সময় গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক বছর জেল খাটেন সাহাবুদ্দিন। এ সময় তিনি ব্যাপক নির্যাতনেরও শিকার হন।
জেল থেকে বের হয়ে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পাশাপাশি আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। দুই বছর আইনজীবী হিসেবে যুক্ত থাকার পর ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে তিনি মুন্সেফ (সহকারী জজ) পদে যোগ দেন।
কর্মের ধারাবাহিকতায় তিনি যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ পদে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালে অবসরে যান।
মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিচারিক কাজের পাশাপাশি তিনি (১৯৯৬-২০০১ সময়কালে) প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান (সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চুপ্পু। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিশনের দাখিলকৃত প্রতিবেদন সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণে সমর্থ্য হন। তার তৈরি তদন্ত প্রতিবেদন কানাডার আদালতেও সমর্থিত হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি তার গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হিসেবে চুপ্পুকে মনোনয়ন দেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচটি ইমামের মৃত্যুতে ২০২১ সালের মার্চ অবধি শূন্য থাকা পদটিতে গত বছর (২০২২) ১৪ জানুয়ারি তাকে চেয়ারম্যান করা হয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিরও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন চুপ্পু।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তন এলে জেডএমসি বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালের জুন মাসে ব্যাংকটির পরিচালক হন চুপ্পু। পরে তিনি ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বাবা শরফুদ্দিন আনছারী ও মা খায়রুন্নেসা। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুর নিবাসী আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ড. রেবেকা সুলতানার সঙ্গে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান।
ড. রেবেকা বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। চুপ্পু-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান রনি দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের উচ্চপদে কর্মরত।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৯৫ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির জীবন-সদস্য।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.