ঔদ্ধ্যত্য আর অডিও-ভিডিওতেই সবশেষ এমপি মোস্তাফিজের

৪৭

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য, প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মিছিল, নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর, দেশের সংকটকালীন সময়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রাজকীয় সংবর্ধনা আদায়, সাংবাদিকদের মারধর, আচরণবিধি লঙ্ঘন, নির্বাচন কমিশনের মামলায় আসামী, প্রতিপক্ষকের উপর হামলা, ওসিকে দেখে নেওয়ার হুমকি, সর্বশেষ পুলিশের হাত কেটে নেওয়ার হুমকিসহ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত বাঁশখালীর (চট্টগ্রাম-১৬) সেই এমপি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। আইনের কাছে ধরাশায়ী দূরে থাক উল্টো দুদণ্ড প্রতাপে একের পর এক ঔদ্ধ্যত্যপূর্ণ আচরণ করে যাচ্ছিলেন তিনি।

বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মনোনয়নপত্র জমা, প্রচার-প্রচারণার মাঠে হামলা, মামলায় শহর থেকে গ্রামে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে প্রায় সময় গণমাধম্যের শিরোনাম হয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও নিজ উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশে পাননি দুইবারের এই সংসদ সদস্য। অবস্থা এমন যে ১০ বছরে এলাকায় জনপ্রিয়তার বদলে কেবল বদনামই কামিয়েছেন তিনি। এজন্য মোস্তাফিজকে ঠেকাতে উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে স্থানীয় জনসাধারণ সবাই এককাট্টা হয়েছেন। যেন এমপি মোস্তাফিজের পতন দেখতে উন্মুখ হয়ে ছিলেন সকলে। কিন্তু এতকিছুর পর তাঁর প্রতাপ কমছিলনা। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের মামলা দায়েরের পর সবাই ভেবেছিল গ্রেপ্তার হবেন এমপি মোস্তাফিজ। সাংবাদিকদের মারধরের প্রতিবাদে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে সাংবাদিকরা। দাবী তোলা হয় তার প্রার্থীতা বাতিলের। কিন্তু আদালত থেকে নির্বাচন কমিশনের করা মামলায় তিনি জামিন পান। এরপর সবার ধারণা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর পর এবার বুঝি শোধরাবেন মোস্তফিজ। কিন্তু না, তিনি হয়ে ওঠলেন আরও বেশি বেপরোয়া। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ৫ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বাঁশখালীর ওসি তোফায়েল আহমেদ ও এমপি মোস্তাফিজের কথোপকথনের একটি অডিও। এতে শোনা যায় এমপি মোস্তাফিজ তাঁর বাড়িতে পুলিশ পাঠানোর কৈফিয়ত চান ওসির কাছে। এমনকি তার লোকজনের গায়ে হাত তুললে ওসিকে হুশিয়ার করে দিয়ে পুলিশের হাত কেটে ফেলার হুমকিও দেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে হত্যার হুমকিদাতা, তাঁর অনুগত বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের উপর যেন কোন কিছু করা না হয় এবং তিনি যেন ওপেন কাজ করতে পারেন সেজন্য ওসিকে সাবধান করে দেন এমপি মোস্তাফিজ। পুলিশের সাথে এমপি মোস্তাফিজের এমন ঔদ্ধ্যত্যপূর্ণ আচরণে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠতে থাকে প্রশাসন। এরপরও কপাল পুড়েনি তার। কোনা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত না আসায় মোস্তাফিজও বেপরোয়া।

এরপরও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। সর্বশেষ ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি চূড়ান্তভাবে কপাল পোড়ে এমপি মোস্তাফিজের। ওইদিন বাঁশখালী থানায় ওসির কক্ষে ঘটে অঘটন। ভোটের চলাকালীন এমপি মোস্তাফিজ ওসির কক্ষে প্রবেশ করেন এবং তার সমর্থক পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল গফুরকে মুক্তি দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন ওসিকে। ভোট কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা এবং কেন্দ্রের দায়িত্বরতদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের অভিযোগে আব্দুল গফুরকে আটক করে। এসময় কয়েকজন পুলিশ সব কিছু মোবাইলে রেকর্ড করছিল। মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড বন্ধ করতে এক পুলিশ সদস্যের দিকে তেড়ে যান এবং মারার চেষ্টা করেন মোস্তাফিজ। এ নিয়ে সখোনে পুলিশের সাথে তৈরী হয় আরেক বিরোধ। এসময় ওসির কঠোর অবস্থানের মুখে থানা থেকে বেড়িয়ে যেতে বাধ্য হন সাংসদ মোস্তাফিজ। ওই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেই চূড়ান্ত পতন নেমে আসে মোস্তাফিজের।

প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি নজরে এলে ওইদিনই মোস্তাফিজের প্রার্থীতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। ইসি সচিব জাহাংগির আলম জানান সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তার প্রার্থীতা বাতিল করা হয়েছে।

জানা যায়, এর পর নিজ ভোটকেন্দ্রে প্রতিপক্ষের হাতে মারধরেরও শিকারও হয়ে আহত হন তিনি। রক্তাক্ত মোস্তাফিজকে চরম অসহায় অবস্থায় দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে। এক দশক ধরে মাঠে ঘাটে প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বেপরোয়া চলাফেরা করা মোস্তাফিজের এমন করুণ হালকে শোচনীয় পতন হিসেবেই দেখছেন বাঁশখালী ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ।

চট্টগ্রাম জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাশার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, তার প্রার্থীতা বাতিল হয়েছে মানে তিনি আর নির্বাচনে প্রার্থী নেই। এখন বাকি যারা আছে তাদের মধ্যে যিনি সর্ব্বোচ্চ ভোট পাবেন তিনি বিজয়ী হবেন।

ঘটনা প্রবাহ:
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে এমপি মোস্তাফিজের অশালীন মন্তব্য করার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর ২০২৩ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করেন মোস্তাফিজুর রহমান। ওই মিছিল ও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর, চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী, কালীপুর ইউপির চেয়ারম্যান আ ন ম শাহাদাত আলমসহ অনেকেই।

২০১৬ সালের ১ জুন ইউপি নির্বাচনে পছন্দ মতো প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ না করায় ইউএন’র কার্যালয়ে দরজা বন্ধ করে নির্বাচন কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামকে মারধর করেন। এ ঘটনায় ওইসময় মোস্তাফিজকে আসামী করে মামলা দায়ের করে নির্বাচন কমিশন।

২০২২ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময় রাজকীয়ভাবে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সংবর্ধনা নেন মোস্তাফিজুর রহমান। ওইসময় অর্থনৈতিক চরম সংকটময় মুহুর্ত অতিক্রম করছিল দেশ। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। গেল ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন মিছিল সহকারে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে হাজির হন তিনি। এসময় আচরণবিধি লঙ্গনের বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সাংবাদিককে তেড়ে গিয়ে চড়-থাপ্পড় দেয়ার চেষ্টা চালান। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আদালত প্রাঙ্গনে সমাবেশ করেন সাংবাদিকরা। পরে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পায় এবং নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার সুপারিশ করে। পরে তার বিরুদ্ধে মামল করে ইসি। এ মামলায় তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান।

গত ১৯ ডিসেম্বর বাঁশখালীতে সংঘর্ষে জড়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান ও মোস্তাফিজের সমর্থকরা। পরে মজিবুরের অনুসারীরা মোস্তাফিজের অনুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা কলে। আর মামলা নেওয়ায় ২২ ডিসেম্বর ওসিকে ফোন করে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় এমপি মোস্তাফিজ। এ ঘটনায় ওসি থানায় জিডি করেন।

এরপরই বাঁশখালীর ওসি তোফায়েল আহমেদকে আবারও ফোনে পুলিশের হাত কেটে নেওয়ার হুমকি দেন তিনি এবং বারবার হুশিয়ার করে দিয়ে ধমক দেন। আর এ কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়। ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি বেলা ১১টা দিকে আবদুল গফুর নামে এক কাউন্সিলরকে আসকরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার অভিযোগে আটক করে পুলিশ। পরে নিজের অনুসারী ওই কাউন্সিলরকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় গিয়ে ওসি তোফায়েল আহমেদকে ধমকান মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়াও নিজ এলাকার কয়েকজন সাংবাদিককে কর্মীদের দিয়ে মারধর ও লাঞ্চিত করার অভিযোগ আছে তার তার বিরুদ্ধে।

তবে নির্বাচনের দিন শেষ মুহূর্তে তার প্রাথীতা বাতিল দেশে একটি নজীরবিহীন ঘটনা। এই আসনে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মুজিবুর রহমান। এর মধ্য দিয়ে বাঁখালীতে অবসান হলো এমপি মোস্তাফিজ যুগের। তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম ১৬ আসন থেকে জয়ী হন।

 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.