কোরআন অধ্যয়ন করেন ব্রিটেনের নতুন রাজা চার্লস

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আসীন ও বিশ্বের প্রবীণতম রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত সপ্তাহে মারা গেছেন। গত বৃহস্পতিবার ৯৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। এদিকে মায়ের মৃত্যুর পর ব্রিটেনের নতুন রাজা হয়েছেন চার্লস।

সিংহাসনে আরোহণের পর তার নাম হয়েছে রাজা তৃতীয় চার্লস। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এবং কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সিংহাসনের অধিকারী হন তিনি। আর এরপরই রাজা তৃতীয় চার্লসের বিষয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে বলে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।

এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ৭৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গত কয়েক দশক ধরে জনসাধারণের নজরেই রয়েছেন। তারপরও চার্লসের দিকে বেশিরভাগ মনোযোগই ছিল মূলত প্রয়াত রাজকুমারী ডায়ানার সঙ্গে তার দুর্ভাগ্যজনক বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে।

যাইহোক, নতুন এই ব্রিটিশ রাজা জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনীতি এবং ধর্মসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিষয়ে নিজের মতামতের জন্যও সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে চার্লস বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন এবং খোলাখুলিভাবে মুসলিম ধর্মের প্রশংসা করেছেন।

লেখক রবার্ট জবসন তার ‘চার্লস অ্যাট সেভেন্টি: থটস, হোপস অ্যান্ড ড্রিমস’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ব্রিটেনের নতুন এই রাজা ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন অধ্যয়ন করেন এবং মুসলিম নেতাদের কাছে লেখা চিঠিতে আরবি ভাষায় স্বাক্ষর করেন।

এখানে ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে রাজা তৃতীয় চার্লসের কিছু চিন্তাভাবনা তুলে ধরা হলো। মূলত এসব বিষয় সমসাময়িক বৈশ্বিক নানা ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত-

পরিবেশ
রাজা তৃতীয় চার্লস কয়েক দশক ধরে পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে একজন স্পষ্টবাদী ব্যক্তিত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলার বিষয়ে অবিলম্বে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খোঁজার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এসেছেন তিনি।

২০১০ সালে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন চার্লস। সেখানে তিনি ইসলাম এবং কোরআন সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির প্রাচুর্যের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

সেখানে রাজা তৃতীয় চার্লস আরও বলেছিলেন, ‘এগুলো স্বেচ্ছাচারী বা অবাধ কোনো সীমা নয়, এগুলো সৃষ্টিকর্তার দ্বারা আরোপিত সীমা এবং কোরআন সম্পর্কে আমার উপলব্ধি সঠিক হলে, মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে- তারা যেন তাদের সীমা লঙ্ঘন না করে।’

ওই একই বক্তৃতায় রাজা তৃতীয় চার্লস আরও বলেন: ‘আমরা এই গ্রহে খুব ভালো একটি কারণে সৃষ্টির বাকি প্রাণীগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে বসবাস করি – এবং তা হলো, আমাদের চারপাশের জীবনের যে জটিল ভারসাম্য রয়েছে সেটি ছাড়া আমরা নিজেরাই এখানে থাকতে পারি না। ইসলাম সর্বদাই এই শিক্ষা দিয়েছে এবং সেই শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে সৃষ্টির সঙ্গে আমাদের চুক্তি ভঙ্গ করা।’

ডেনিশ কার্টুন
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে ব্যঙ্গ করে ২০০৫ সালে একটি ড্যানিশ কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে মিশরের কায়রোতে অবস্থিত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে সফরের সময় সেই ঘটনার সমালোচনা করেছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লস। সেসময় সবাইকে অন্যের বিশ্বাসকে সম্মান করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি।

সেখানে এক বক্তব্যে চার্লস বলেন, ‘সংখ্যালঘু এবং অপরিচিতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাই হলো একটি সভ্য সমাজের প্রকৃত চিহ্ন… ডেনিশ কার্টুনের বিষয়ে সাম্প্রতিক ভয়ঙ্কর বিবাদ এবং ক্ষোভ আমাদের অন্যদের কথা শোনার ও অন্যদের কাছে যা মূল্যবান এবং পবিত্র তা সম্মান করতে ব্যর্থতার বিপদটিই দেখিয়ে দিয়েছে।’

বাক স্বাধীনতার নামে চিত্রিত এসব কার্টুন পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম বিদ্বেষ এবং বাকস্বাধীনতার সীমা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।

রমজান
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে রাজা তৃতীয় চার্লস বলেছিলেন, সবাই ‘রমজানের চেতনা থেকে’ শিখতে পারে। মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘শুধু উদারতাই নয়, সংযম, কৃতজ্ঞতা এবং প্রার্থনায় একতাবদ্ধতা বিশ্বজুড়ে অনেককে মহান স্বস্তি দেবে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মুসলিমদের উদারতা ও সহৃদয় আতিথেয়তা আমাকে বিস্মিত করে না এবং আমি নিশ্চিত যে, যখন আমরা আরও অনিশ্চিত সময়ে প্রবেশ করব … রমজান মাস মুসলিম সম্প্রদায়ের আবারও বিশাল মহানুভবতার উৎস হবে।’

ইসলাম ও পাশ্চাত্য
রাজা তৃতীয় চার্লস দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে কাছাকাছি আনার পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি বরাবরই বলে এসেছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর ‘ভুল বোঝাবুঝি’ রয়েছে।

১৯৯৩ সালে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে দেওয়া বহুল আলোচিত এক বক্তৃতার সময় রাজা তৃতীয় চার্লস বলেছিলেন, ‘ইসলামের প্রকৃতি সম্পর্কে পশ্চিমে যদি অনেক ভুল বোঝাবুঝি থাকে, তবে ইসলামিক বিশ্বের কাছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সভ্যতার ঋণ সম্পর্কেও (আমাদের) অনেক অজ্ঞতা রয়েছে। এটি একটি ব্যর্থতা বলেই আমি মনে করি। ইতিহাস থেকে যা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি।’

চার্লস সতর্ক করে দিয়ে সেসময় বলেছিলেন, চরমপন্থাকে কেবল ইসলামের ‘বিষয়’ হিসাবে দেখা উচিত নয়। তিনি বলেছিলেন, এটি কেবল ‘ইসলামের একচেটিয়া অধিকার নয় বরং এটি খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের একচেটিয়া বিষয়’।

উল্লেখ্য, মায়ের মৃত্যুর পর গত শনিবার ব্রিটেনের নতুন রাজা হয়েছেন প্রিন্স চার্লস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী, রানির মৃত্যুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই রাজার পদবি পান সাবেক এই প্রিন্স অব ওয়েলস।

নতুন এই ব্রিটিশ রাজা ‘রাজা তৃতীয় চার্লস’ নামে পরিচিত হবেন। একই সঙ্গে তিনি ১৪টি কমনওয়েলথ দেশেরও রাজা হবেন।