পিতাম্বর শাহ: দুইশ’ বছর ধরে চট্টগ্রামে চলছে যে ব্যবসা

কথিত আছে চট্টগ্রামের সন্তানরা মা-বাবার কাছে কোন জিনিসের বায়না ধরলে তারা বলতেন বাড়িটা কি পীতাম্বর শাহ’র দোকান পেয়েছিস? যে যা চাইবি তাই পাবি? শুধু তাই নয় চট্টলায় আরও জনশ্রুতি আছে যে খাতুনগঞ্জের বক্সিরহাট জেলরোড়স্থ পীতাম্বর শাহ’র দোকানে বাঘের দুধ থেকে শুরু করে মৃত মানুষের চুলও বিক্রি হয়। এখান থেকেই দোকানটির বহুমাত্রিক সংগ্রহ ও ব্যাপক পরিচিত সম্পর্কে ধারণা মেলে। প্রায় দুইশো বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পীতাম্বর শাহ’র দোকানে জীবনের প্রয়োজনীয় হেন কোন জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। মূলত এ কারণেই বহুকাল ধরে দোকানটির খ্যাতি সমগ্র দেশজুড়ে। চট্টগ্রামের যেকোন প্রান্তের মানুষ এ দোকানটিকে একনামেই চিনে থাকে। এমনকি এ দোকানকে নিয়ে স্থানীয় কিছু লোককথা প্রচলিত আছে আজও। বলা হয় যে, এখানে নাকি বাঘের দুধও মিলে, আরও বলা হয়, ” যাহা মিলেবে না ইহকালে তাহা মিলিবে পীতাম্বর শাহ’র দোকানে”।

পুরোনো এ দোকানের উপরের অংশ জরাজীর্ণ হওয়ায় সংস্কার করতে হয়েছে। ফলে এর মূল অবয়বে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। তবে দোকানটির ভেতরে প্রবেশ করলেই এটির প্রাচীনত্ব আঁচ করা যায়। বাইরের পিলার, দরজা, লোহার শিক, বহু পুরোনো ধাতুর ড্রয়ার, কাঠের তাক, শত বছর আগের পুরোনো সব বোতল সাক্ষ্য দেয় দোকানটি কত পুরোনো, কত কাল আগের।

পীতাম্বর শাহ’র দোকানে প্রবেশের আগে বাইরের বারান্দায় চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো সব দুর্লভ জিনিসপত্র। যা এখন একেবারেই বিরল। প্রাচীনকালের মানুষ জুতোর পরিবর্তে কাঠের তৈরি খড়ম পরিধানর করতেন। সেই খড়মের দেখা মেলে এখানে। যার প্রচলন এখনকার সময়ে নেই বললেই চলে।

শুধু যে ঐতিহ্যের খড়ম তা নয় এ দোকানে দেখা মেলে প্রতিমার চুল, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পিতৃ-বিয়োগে ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য বাঁশের শলা, তালপাতার পাখা, ঢালা, কুলা, ঝুড়ি ইত্যাদি।

এছাড়াও রন্ধন শিল্পের নানারকম মসলার সমাহার এ দোকানটি। বিশেষ করে চাটগাঁইয়া মেজবানিতে ব্যবহৃত হরেকপদের মসলা পাওয়া যায় পীতাম্বর শাহ’র দোকানে। আজও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মানুষ পীতাম্বর শাহ’র দোকানের মসলার উপর নির্ভরশীল। এ দোকানে ভালো মানের মসলা যেমন পাওয়া যায় তেমনি বিশেষ এক কারণে এখানে মসলা কিনতে ভিড় করেন ক্রেতারা।

সাধারণত আমরা যখন দোকানে কোনকিছু কিনতে যাই তখন দোকানি ঠোঙা বা প্যাকেটসহ পাল্লায় ওজন করে থাকে। কিন্তুু পীতাম্বর শাহ’র দোকানের বিশেষ রেওয়াজ হলো এখানে কেবল ক্রয়কৃত জিনিসটুকুই পাল্লায় দেয়া হয়। ঠোঙ্গা কিংবা প্যাকেটের ওজন এখানে করা হয় না। যা আজকালের যামানায় একেবারেই ব্যতিক্রম।

এসব কারণে এ দোকানে মসলা কিনতে ভিড় জমান শতশত ক্রেতা। অনেক ধরণের মানুষও এখানে সদাই করতে এসে দিয়ে যায় ধৈর্যের পরিচয়। বলা হয় যে ভালো জিনিস কিনতে মানুষেরা বহুদূর থেকে এসেও বিরক্ত হন না, বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও পীতাম্বর শাহ’র দোকানে এসে থাকেন তারা।

পীতাম্বর শাহ’র দোকানের ইতিহাস:
প্রায় ১৮০ বছর আগে পীতাম্বর শাহ ঢাকা থেকে পাঁয়ে হেঁটে চট্টগ্রামে এসে পৌছান। এরপর তিনি দোকানটি কিনে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। অবাক হলেও সত্য যে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় একই আদলে ব্যবসায়টি পরিচালনা করে আসছেন পীতাম্বর শাহ’র উত্তরসূরীরা। বর্তমানের তাঁর চতুর্থ প্রজন্ম দোকানটি পরিচালনা করছেন।

সজারুর কাঁটা, সামুদ্রিক মাছের কাঁটা, দাঁত (তান্ত্রিকরা ব্যবহার করেন), প্রাচীনকালে ভারতের বিখ্যাত তালমিসরী পাওয়া যায় এ দোকানেই।

হরিণের কস্তুরী, কাশ্মীরী জাফরান এখানেই মেলে। এমনকি বাঘের দুধও মেলে এ দোকানে। শুনতে অবাক হলেও এটিই সত্য। একসময় পীতাম্বর শাহ’র দোকানে বাঘের দুধ বিক্রি হতো। সেসময় মানুষজন বিশ্বাস করতেন ছোট বাচ্চাদের বাঘের দুধ খাওয়ালে তারা বাঘের ন্যায় শক্তিশালী হবেন। আর এজন্যই বিক্রি হতো বাঘের দুধ।

কিভাবে সংগ্রহ করা হতো বাঘের দুধ। যে বাঘ মানুষের আতঙ্ক। বলা হয়ে থাকে বাঘের নাম শুনলেই কলিজায় পানি চলে আসে। সেই বাঘের দুধ সংগ্রহের কথা জানালেন পীতাম্বর শাহ’র দোকানের ম্যানেজার সাধন বাবু। তিনি বলেন, তখনকার সময়ে পাহাড়ি উপজাতিরা বাঘের দুধ সংগ্রহ করে তাদেরকে দিতেন। আর তারা কিনে নিতেন। বাঘ যখন বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতেন তখন কিছু পরিমাণ দুধ নিচে পড়ে যেত। কেননা বাঘের বাচ্চাদের জিহবা খুব ধারালো। এজন্য বাচ্চারা আলতোভাবে মায়ের দুধ পান করতো৷ তখন কিছু দুধ নিচে পড়ে যেতো। যা চাক চাক অবস্থায় পড়ে থাকতো। পাহাড়ি উপজাতিরা এ সম্পর্কে খুব অভিজ্ঞ ছিলো৷ তারা দেখলে বুঝতে পারতো কোনগুলো বাঘের দুধ। কোন প্রাণি সেগুলোতে মুখ না দিলে সেই দুধ ব্যবহার করা যেতো। এভাবেই তারা বাঘের দুধ সংগ্রহ করে আমাদের দোকানে সরবরাহ করতো। তবে এখনও আর চট্টগ্রামের পাহাড়ে বাঘ নেই, নেই সেই পাহাড়িরাও। তাইতো পীতাম্বর শাহ’র দোকানের বাঘের দুধের কৌটাগুলো এখন শূণ্য।

এ দোকানে আরও চোখে পড়ে ধূলোয় আচ্ছাদিত পুরাতন অসংখ্য কাঁচের বোতল, ধাতুর তৈরী ড্রয়ার। যাতে রাখা হয়েছে মূল্যবান ও বিরল সব জিনিসপত্র। সৌদি আরবের মারিয়াম বৃক্ষের শিকড়, যোষ্ঠ মধু, ভেড়ার চুল, মূয়ুরের পালক কি নেই এখানে? সবকিছুই পাওয়া যায় পীতাম্বর শাহ’র দোকানে।

পীতাম্বর শাহ’র দোকানে সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। শেষ যাত্রার সব উপকরণ আজও কেনা হয় এ দোকান থেকে। তাছাড়া সাজসজ্জার নানা কিছু পাওয়া যায় এখানে। বিশেষ করে প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যবহৃত পুঁথি ও কাগজের মালা, চুড়ি, শাড়ি, গহনাসহ সব ধরণের জিনিসই খুঁজে পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম শহরের অলিতে-গলিতে রয়েছে অসংখ্য মাজার। এসব মাজারে বার্ষিক ওরশে জ্বালানো হয় বড় বড় সাইজের মোমবাতি। যা দামেও অনেক বেশি৷ এসব মোমবাতি দেখেই অনেক ভাবেন কোথা থেকে আনা হয়েছে এসব মোমবাতি? হ্যাঁ, আপনার দেখা সেসব মোমবাতিও কেনা হয় পীতাম্বর শাহ’র দোকান থেকে।

বাংলার আরেক ঐতিহ্য হালখাতা। যা এখন হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত প্রায় এই প্রথাটিও আজও মানা হয় পীতাম্বর শাহ’র দোকানে। বাংলা সনের নববর্ষ এলেই এখানে পালন করা হয় হালখাতা উৎসব। বাংলার চিরচেনা ঐতিহ্য হালখাতা হারিয়ে গেলেও তা রক্ষার শেষ ভরসা পীতাম্বর শাহ’র দোকান।