সাজাপ্রাপ্ত আসামীর পরিবর্তে প্রায় ৩ বছর কারাভোগের পর চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, নিরপরাধ মিনু আকতার।
বুধবার (১৬ জুন) বিকেলে সাড়ে ৪টায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে মিনু মুক্তি পান।
এর আগে বুধবার (১৬ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত মিনুকে মুক্তির আদেশ দেন। পরে তার মুক্তি সংক্রান্ত কাগজ পৌঁছে চট্টগ্রাম কারাগারে।
জানা যায়, মোবাইল ফোন নিয়ে বিবাদের জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় খুন হন পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনুর বেগম । এ ঘটনায় করা মামলায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার উপজেলার মাঝেরপাড়া গ্রামের আনু মিয়ার মেয়ে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তিনি স্বামী ছালেহ আহমদের সঙ্গে কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জে সাঈদ ডাক্তারের ভাড়া থাকতেন। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমী। পরবর্তীতে এ মামলায় বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এক রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো একবছরের কারাদণ্ড দেয়। রায়ের দিন কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তাকে পলাতক দেখিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
মিনু আইনজীবি এড. গোলাম মওলা মুরাদ জানান, পলাতক আসামী কুলসুমী জেল জীবন থেকে বাঁচতে ফন্দি আটে। ভাসমান বস্তিতে খোঁজ পায় মিনুর। মিনু থাকেন সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুরের জাফারাবাদ এলাকায়। মিনুর স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে ভাসমান বস্তিতে থাকতেন। তার পিতার নাম সোলাইমান ও মা সালেহ বেগম, স্বামী মোহাম্মদ বাবুল। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার ময়নামতিতে। মিনুর দুই ছেলে ও একমেয়ে। বড় ছেলে ইয়াছিন (১২)। সে একটি দোকানের কর্মচারি। আরেকজন গোলাম হোসেন (৭) হেফজখানায় পড়ছে। ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৫) দত্তক দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মিনু ও তার সন্তানদের ভরনপোষন দেওয়ার প্রস্তাব দেয় কুলসুমী। বিনিময়ে একদিন আদালতে হাজির হতে হবে বলে জানানো হয় মিনুকে। আদালতে হাজির হলে তার জামিনও করিয়ে আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মিনু কুলসুমীর কথায় রাজি হয়ে কুলসুমী সেজে ২০১৮ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম আদালতে আত্মসমর্পন করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে মিনু কারাবন্দী। এরপর নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন কুলসুমী।
পরে আইনজীবিরা বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে গত ২৩ মার্চ মিনুর নথি হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞার আদালত এ আদেশ দেন। পরে মামলার নথি হাইকোর্টে এলে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।
সর্বশেষ গত ৭ জুন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ মিনুকে মুক্তির আদেশ দেন। আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. শিশির মনির। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ।
মিনুর পক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘বিগত দুই বছরে আমাদের দেশে এমন ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। একজনের নামে আরেকজন জেলে থাকছে। অথচ আসল আসামি শনাক্তে অনেক পদ্ধতি আছে। আইবলিং পদ্ধতি আছে, এতে শনাক্ত করলে কোনও ভুল হবে না। এ বিষয়ে আমি লিখিতভাবে আদালতকে আরও জানাবো। তবে মিনুর ঘটনার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে। এ ঘটনায় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা দাবি করছি।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম কারাগারের একটি বালাম বই দেখতে গিয়ে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, একজনের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন আরেক নারী। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে এ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রামের আদালত।
কোনও কিছুর মিল না থাকায় একজনের স্থলে আরেকজন জেল খাটার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান।