চৌধুরী ফরিদ:
কর্ণফুলী নদীর মুখে মাটি নরম হওয়ায় এই টানেল নির্মাণ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছার সাথে দেশি বিদেশী প্রকৌশলীদের প্রচেষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল আজ বাস্তবে রূপ নিলো।
দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক প্রান্তে রয়েছে শহর ও বন্দর এবং অপর প্রান্তে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হয়েছে, যা দেশের বর্তমান উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে এতো ব্যাপক সংখ্যক যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমার ঘটনা চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারীতার জন্য বড় হুমকি। তাই এই পলি জমার সমস্যার কারণে কর্ণফুলী নদীর উপর আর কোন সেতু নির্মাণ না করে টানেল নির্মাণের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। এজন্য আনোয়ারার মাটি ও মানুষের নেতা, বিশিষ্ঠ শিল্পপতি, দানবীর, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জননেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দাবীর প্রেক্ষিতে দেশের উন্নয়নের কান্ডারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারা অংশকে সংযুক্ত করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পতেঙ্গা-আনোয়ারা প্রান্তে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক নগরী। কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এই বন্দরের মাধ্যমেই দেশের ৯০শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এই টানেল বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। এই টানেল সাইটে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ৭০০ মিটার এবং পানির গভীরতা ৯থেকে ১১ মিটার।
দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বঙ্গবন্ধু টানেল দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম টানেলও বটে। এটি পদ্মা সেতুর পর আমাদের জন্য তথা দেশের জন্য আরেকটি বিস্ময় এবং বড় অর্জন।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে।
মূল টানেলের বাইরে দুই প্রান্তে সংযোগ সড়ক রয়েছে ৫ দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী প্রথম উত্তর সুড়ঙ্গের খননকাজের উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী টিউব উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, টানেলের কারণে চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। এটি দেশের জন্য আরেকটি বিরাট অর্জন। টানেলের কারণে কর্ণফুলী নদীর উভয় অংশ সমানভাবে উন্নত হবে, বিশেষ করে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সুযোগ সৃস্টি হবে। টানেলের মাধ্যমে ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে উঠবে। প্রথম টিউব বা সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের খননকাজ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর। গত বছরের ৭ অক্টোবর এই খননকাজ শেষ হয়। সে সাথে দুটি সুড়ঙ্গের মধ্যে তিনটি ক্রস প্যাসেজ বা সংযোগপথও নির্মাণ করা হয়। টানেলের জন্য নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৪১ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করতে হয়েছে। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার এই টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার ৬শত কোটি টাকার বেশি।
সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে এই টানেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড।
এই টানেলের ভেতরে অগ্নিপ্রতিরোধক বোর্ড, ডেকোরেটিভ বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। টানেলের দুই প্রান্তে ১৫ মেগাওয়াটের একটি করে দুটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার ।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, নিরাপত্তার জন্য এই টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৩টি এবং পতেঙ্গা প্রান্তে ২টি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। সব গাড়ী স্ক্যানার হয়ে এই টানেলে প্রবেশ করতে পারবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধনের পরদিন সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তবে দূর্ঘটনা এড়াতে সি এনজি এবং মোটর সাইকেল টানেল দিয়ে আপাতত চলাচল করতে পারবে না। এই টানেল নির্মাণে চায়না প্রকৌশলীর সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরাও কাজ করেছে। এতে তারা ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। আগামীতে অন্য কোন টানেল নির্মাণে বাংলাদেশী প্রকৌশলীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
টানেলে পারাপারে টোল ধরা হয়েছে- কার, জীপ, পিকআপ ২০০টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস ছোট ৩০০টাকা, বাস বড় ৪০০ টাকা, বাস ৩ এক্সেল ৫০০ টাকা, ট্রাক ৫ টন ৫০০ টাকা, ট্রেইলর ১০০০ টাকা।
কর্ণফুলী নদীর মুখে মাটি নরম হওয়ায় এই টানেল নির্মাণ বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এই কারণে প্রথমদিকে চার মাস নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। মহান আল্লাহর রহমতে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার সাথে দেশি বিদেশী প্রকৌশলীদের প্রচেষ্ঠায় আজ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল বাস্তব রূপ নিলো।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজার পর্যন্ত যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটবে। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা হয়ে উঠবে অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বাড়বে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ।
এই টানেলকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছে আনোয়ারা সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। টানেলের আশপাশের এলাকায় দেখা দিয়েছে পরিবর্তনের হাওয়া। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা, দোকানপাট, শপিংমল ও অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট। চায়না ইকোনোমিক জোন এবং কেইপিজেড সহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশা করছেন অভিজ্ঞমহল।
চৌধুরী ফরিদ, বিভাগীয় প্রধান, চ্যানেল আই চট্টগ্রাম।