উদ্বোধন হলো বাঙালির সাহস ও মর্যাদার প্রতীক পদ্মাসেতু। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ প্রকল্প পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে মাওয়া প্রান্তে টোল পরিশোধ শেষে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দেন।
এর আগে জমকালো আয়োজনে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে শুরু হওয়া বহুল প্রতিক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সকালে হেলিকপ্টার যোগে অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে অংশ নিয়েছেন দেশি বিদেশি কয়েক হাজার আমন্ত্রিত অতিথি।
উদ্বোধনী বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর প্রকাশ করেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু শুধু ইট সিমেন্ট স্টিল কংক্রিটের অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার গর্ব আত্মমর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ, গর্ব আর সাহস। কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারেনি।
বক্তব্যের শুরুতে সরকারপ্রধান ১৫ আগস্ট নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
যারা জমি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি। পদ্মা সেতু কেবল ইট সিমেন্টের সেতু নয়, এই সেতু আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ। আমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তারুণ্যের কবি, দ্রোহের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ভাষায় তাই বলতে চাই: সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।
তিনি বলেন, আমরা মাথা নোয়াইনি। বাঙালি জাতি কখনও মাথা নোয়ায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখাননি, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তারই নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনা সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আজকে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বসে পড়েনি। বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি, আমরাও পারি। পদ্মা সেতু তাই আত্মমর্যাদা ও বাঙালির সক্ষমতা প্রমাণের সেতু শুধু নয়, পুরো জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধও। বাংলাদেশের জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা।’
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ঐতিহাসিক দিনে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দেশের কল্যাণের কাজ করার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যাঁর অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নেই। বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতীক্ষা আর রক্ত ধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।’
উদ্বোধন ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী টোল প্লাজায় যান। সেখানে তিনি টোল প্রদান করেন। টোল প্রদান করে প্রধানমন্ত্রী মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন। উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যাবেন। জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক এবং ম্যুরাল-২ উন্মোচন করেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে যান। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগ এ জনসভায় ১০ লাখ লোক জমায়েত করার ঘোষণা দিয়েছে।
জনসভায় যোগদান শেষে জাজিরা প্রান্তের সার্ভিস এরিয়া-২ তে যাবেন। সেখানে তিনি হেলিকপ্টারে ঢাকায় ফিরে আসবেন।
এদিকে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা রয়েছে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট এবং আশপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। সভাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা।
প্রসঙ্গত ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। ধীরে ধীরে গতিহীন হয়ে পড়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর জন্য ডিজাইন কনসালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হয়। কনসালট্যান্ট সেপ্টেম্বর ২০১০-এ প্রাথমিক ডিজাইন সম্পন্ন করে এবং সেতু বিভাগ প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সরকার। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন থেকে পিছিয়ে যায় বিশ্বব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের আবেদন বিশ্বব্যাংক থেকে ফিরিয়ে নেয় সরকার। যদিও পরবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
নানা অভিযোগ ষড়যন্ত্র চাপ উপেক্ষা করে ২০১২-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। ২০১২ সালের ৪ জুলাই সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ জুলাই আবারও সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ জাতির সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর নির্মাণ কাজে ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদীশাসন করেছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে স্ব-অর্থায়নে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের ব্যয় ১২,১৩৩.৩৯ কোটি টাকা (৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার এবং গ্যাস লাইনের জন্য ১০০০ কোটি টাকাসহ) এবং ১৩.৮ কিলোমিটার নদীশাসন কাজের ব্যয় ৯,৪০০০.০ কোটি টাকা।
টোল প্লাজা এবং এসএ-২সহ ১২ কিমি অ্যাপ্রোচ রোডের নির্মাণ ব্যয় ১,৯০৭.৬৮ কোটি টাকা (২টি টোল প্লাজা, ২টি থানা ভবন এবং ৩টি পরিষেবা এলাকাসহ) যেখানে পুনর্বাসনের ব্যয় ১,৫১৫.০০ কোটি টাকা, ২৬৯৩.২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় ১২৯০.৩ কোটি টাকা, কনসালটেন্সি ৬৭৮৩.৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, ফিজিক্যাল এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি, ইন্টারেস্ট ইত্যাদি) ১,৭৩১.১৭ টাকা।