পটিয়ার চার গ্রামে সুপেয় পানি সরবরাহের নির্দেশ হাইকোর্টের

দেশের কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা দাবি জানিয়ে এটিই প্রথম আইনি পদক্ষেপ

পটিয়া উপজেলার হাবিলাস দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের ভূ-গর্ভস্থ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে পানি উত্তোলন করে আসছিল আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এতে পটিয়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বসানো ৩৫ টি টিউবওয়েল অচল হবার পাশাপাশি ওইসব গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ খাবার পানির তীব্র সংকটে পড়ে। শুধু তাই নয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছয়টিরই নেই পরিবেশগত ছাড়পত্র। এমনকি বেশির ভাগই বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া পরিচালিত হচ্ছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের সৃষ্ট দূষণে পাশের বোয়ালখালী, গরুলতা এবং আলমডাঙা খালের পানিও দূষিত হয়ে পড়েছে। এতে চাষাবাদের পানির তীব্র সংকটে পড়ে গ্রামবাসী। স্থানীয়দের আপত্তি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানা কোনকিছুরই তোয়াক্কা করছিল না প্রতিষ্ঠানগুলো। উল্টো আইন লঙ্ঘন করে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছিল।

চার গ্রামের জনসাধারণের দীর্ঘ দিনের এ ভোগান্তি নিরসনে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে রিট দাখিল করে। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর আদালত ওই রিটের পক্ষে রায় দেয়। সর্বশেষ গতকাল ৩১ জানুয়ারি পানিস্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিবাদীদের (সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা) রায়ে উল্লেখিত নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসাথে ওইসব গ্রামে সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

হাইকোর্টের বিচারপতি মাহমুদুল হক এবং বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ প্রদত্ত এ আদেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি), জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সহকারী প্রকৌশলীকে আগামী ৩ মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

আদালতে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন বেলার নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না। আদেশের বিষয়টি চট্টগ্রাম টুয়েন্টিফোর ডট নিউজকে নিশ্চিত করেন অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না।

জানা যায়, পটিয়ার চার গ্রাম থেকে বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি (ফুড প্রোডাক্টস), বনফুল অ্যান্ড কোম্পানি (মিনারেল ওয়াটার), আম্বিয়া নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড, আম্বিয়া পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেড, মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেড, হাক্কানী পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেড, আনোয়ারা পেপার মিলস লিমিটেড ও শাহ আমানত নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড ভূ-গর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করে আসছিল। এতে স্থানীয়রা তীব্র খাবার, চাষাবাদ ও ব্যবহারের পানির সংকটে পড়ে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে একটি রিট দাখিল করেন। মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে রিটটি চলমান ঘোষণা করেন। মামলার শুনানিতে পরিবেশ অধিদপ্তর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষণ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে তাতে স্পষ্ট হয় যে গ্রামগুলোতে এখন আর হস্ত চালিত পাম্প বা টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উত্তোলন সম্ভব নয়। ফলে সরকার মাটির ১৫০ মিটার নিচ থেকে পানি উত্তোলনে সক্ষম এমন পাম্প বসিয়ে এলাকাবাসীর পানি চাহিদা মেটাতে উদ্যোগ নিচ্ছে।

সরকারের এমন উদ্যোগ ক্ষয়িষ্ণু ভূগর্ভস্থ পানি স্তরে আরও চাপ সৃষ্টি করবে জানিয়ে সরকারের এমন উদ্যোগের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন বেলার আইনজীবীরা।

শুনানি শেষে আদালত পানি আইন ২০১৩-এ ধারা (১৭)- এর অধীনে চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া এবং হাবিলাস দ্বীপ গ্রামকে পানি সংকাটাপন্ন এলাকা ঘোষণার বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসককে আটিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণের পরিমাণ যাচাই করে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

ভবিষ্যতে এই চারটি গ্রামে বিকল্প পানির ব্যবস্থা না করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে কোন ‘লাল’ বা ‘কমলা-খ’ শ্রেণির শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে পারবে না। পটিয়া উপজেলায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া এবং কার্যকরী বর্জ্য শোধনাগার প্ল্যান ছাড়া কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন পরিচালিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মেমো প্রস্তুত করে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পানি আইনের অধীনে দেশের কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা দাবি জানিয়ে এটিই প্রথম আইনি পদক্ষেপ।

খাবার পানির সংকটপটিয়া