মর্মান্তিক দুর্ঘটনা: কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি ড. মুহাম্মদ হোসেনের

২২তম মৃত্যুবার্ষিকী শুক্রবার

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মুহাম্মদ হোসেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মাহমুদাবাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৌলভী এমদাদুল হক আর মা হাজেরা খাতুন। তিনি ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। স্কুলজীবনে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়ে দেশপ্রেমের দীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১৯৫৬ সালের আইএসসি পরীক্ষার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি স্কলারশিপ পান। ১৯৫৮ ও ৬০ সালে ফ্যাকাল্টি স্কলারশিপ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি.এসসি ও প্রাণ-রসায়নে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সেরা প্রবাসী ছাত্রনেতৃত্বের জন্যে পুরস্কারে ভূষিত হন।

ড. মুহাম্মদ হোসেন ১৯৬২ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিনমাস পরে প্রাণ-রসায়নের প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-রসায়ন বিভাগ ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ বিভাগের উন্নয়ন ও বিকাশে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-রসায়ন বিভাগের জনক হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৬৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি একই বিভাগে সহকারি অধ্যাপক, ১৯৭০ সালের ২৭জুন সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৭৭ সালের ২১মে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বরে ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের আগে তিনি বিভিন্নসময়ে প্রাণ-রসায়ন বিভাগের প্রধান, কৃষি অনুষদের ডীন, শহীদ শামসুল হক হলে প্রভোস্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপক মুহাম্মদ হোসেনের মধ্যে সাংগঠনিক নেতৃত্বদানের সহজাত প্রতিভা ছিল। তিনি দু’বার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’র সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু তাঁর সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। অধ্যাপক হোসেনের সবচে’ বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে, একজন সফল শিক্ষাপ্রশাসক হিসেবে, সর্বোপরি একজন সৎ, ধার্মিক ও সাহসী মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের সামনে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন-তা আমাদের সকলের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক পথে সীতাকুণ্ডে ফেরার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হারায় একজন প্রতিভাবান ও যোগ্যতম উপাচার্যকে, সীতাকুণ্ডবাসী হারায় তাদের কৃতিসন্তানকে আর তাঁর পরিবার হারায় যোগ্য এক অভিভাবককে।

মৃত্যুকালে অধ্যাপক মুহাম্মদ হোসেন স্ত্রী, একপুত্র, দুইকন্যা, নাতি-নাতনীসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, ছাত্রছাত্রী, গুণগ্রাহী, বন্ধু ও সহকর্মী রেখে গেছেন।

তাঁর একমাত্র পুত্র ক্যাপ্টেন তানভীর মুহাম্মদ নাফিউল হোসেন ও বড় মেয়ে নাহিদ হোসাইন নভেলী, ছোট মেয়ে নাফিসা হোসাইন মোনালী। তিনজন-ই দেশ-বিদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। ক্যাপ্টেন তানভীর চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড এর চিফ অপারেটিং অফিসার, বড় মেয়ে নাহিদ হোসাইন নবেলী আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ এর ভাইস-প্রিন্সিপাল ও ছোটমেয়ে নাফিসা সেভরণ গ্যাস কোম্পানিতে পরিচালক, এইচআর এন্ড এডমিন হিসেবে কর্মরত। তাঁর স্ত্রী জোহরা হোসেন তাদের পারিবারিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুহাম্মদ হোসেন একাডেমি পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান।

Comments (৩)
Add Comment