সবার সমান অধিকারের দেশ তৈরি করতে চাই উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই,যে বাংলাদেশে যারা এই দেশের নাগরিক, তাদের সবারই সমান অধিকার, এটা যেন আমরা নিশ্চিত করি। শুধু কিতাবে লিখে দিলে হবে না। এরপর কাটাকাটি মারামারি এগুলো করলাম, অধিকার কেড়ে নিয়ে বাহবা পেলাম, এরকম বাংলাদেশ আমরা চাই না।
তিনি বলেন, এরকম সমাজ চায় না বলেই ছাত্র-জনতা তাদের জীবন দিয়েছে। নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার স্বপ্ন নিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছে। আমরা এ স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চাই। এটা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না।
শনিবার (১২ অক্টোবর) রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবল্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবার দুর্গাপূজার আনন্দ বিশেষ আনন্দে পরিণত হয়েছে। দেশজুড়ে যেটা সবাই উপভোগ করছে। এ আনন্দ আরেকটু বেড়ে গেলো এজন্য, একদম নির্বিগ্নে সব জায়গায় পূজার অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই চেষ্টা করেছে, কোনও রকম দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, কোনও রকম আতঙ্কজনক পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়। এজন্য সরকার এবং সরকারের বাইরে সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে।’
তিনি বলেন, সবাই মিলে অত্যন্ত গৌরবপূর্ণ দুর্গাপূজা করতে পারার পেছনে সরকারের বড় একটা প্রতিষ্ঠান আমাদের সহযোগিতা করেছে। তারা হলো— পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি— যত রকমের সরকারের কাছে শাস্তিরক্ষার বাহিনী ছিল সবাই। সবাই আন্তরিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছেন।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নিজেদের মনে করিয়ে দেই— সেনাবাহিনীকে দিয়ে, পুলিশকে দিয়ে, র্যাবকে দিয়ে আমাদের আনন্দ, উৎসব করার আয়োজন করতে যাওয়াটা আমাদের ব্যর্থতা। এটা স্বাভাবিক না। এই ব্যর্থতাকে আমরা এবারের জন্য গ্রহণ করেছি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা সমাজটাকে যে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি নাই, কোনও জায়গায় একটা অংশ আনন্দ উৎসব করবে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে আনন্দ উৎসব করবো, তাও সম্ভব হচ্ছে না, আমাদেরকে দিয়ে। এ রকম সমাজকে নিয়ে আমরা কী করবো। এ রকম সমাজ কি আমরা চাই? আমরা এ রকম সমাজ চাই না।’
তিনি বলেন, ‘সমাজের যেকোনও অংশ উৎসব করবে, আমরা সবাই মিলে সেখানে শরিক হবো। তারা যেন নির্বিগ্নে, আনন্দের সঙ্গে উৎসব করতে পারে, সে জন্য বাকি অংশ তাদের সহায়তা দেবো। তারা নিজেরা এই আনন্দে অংশ নেবে— এটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা ওটা করতে পারছি না। এটা করতে পারছি না বলেই আমাদের ছাত্র-জনতার, শ্রমিক এরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে আজকে আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই যে আমরা আপনাদেরকে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে পূজা উৎসবের সুযোগ করে দিলাম, এটা যেন ভবিষ্যতে আর কখনও করতে না হয়, সে জন্য আমরা একযোগে কাজ করবো।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা অনেকেই সংস্কারের কথা বলেছেন। সংস্কারের মধ্যে সবকিছু লুকানো আছে-ঢোকানো আছে। অর্থাৎ আমরা সমাজে যা কিছু অপছন্দ করছি, তা থেকে যেন বের হয়ে আসতে পারি। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা পূর্ণ অধিকার নিয়ে রাস্তাঘাটে চলতে পারে, মানুষের সঙ্গে চলতে পারে, যেকোনও অনুষ্ঠানে যেতে পারে। অন্য যেকোনও নাগরিকের ছেলেমেয়ে যে অধিকার পায়, আপনাদের সন্তানও সেই অধিকার পাবে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশে আমাদের কী কী নতুন দরকার তা বের করে আনতে হবে। সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা কতগুলো কমিশন বানিয়ে দিয়েছি। তারা তো দেশ পাল্টিয়ে ফেলতে পারবে না। তাদের সেই সাধ্যতো নেই। কমিশন করেছি এই জন্য যে, তারা আমাদের স্বপ্নগুলোকে একত্র করবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণে মহাস্বপ্নে আমরা চলে এসেছি। এ স্বপ্নের একটা রূপরেখা থাকবে। আমরা বলছি, সংবিধান সংশোধন করবো, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রথা সংশোধন করবো, অনেককিছু।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা অত্যাচারিত হয়েছি। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এমন একটা সমাজ থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি, যেখানে সমস্ত অধিকার ছিল ছোট্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে। বাকি মানুষের কোনও অধিকার ছিল না। আমরা সব অধিকার বঞ্চিত ছিলাম। এই অভ্যুত্থান হঠাৎ করে সেটা পাল্টে ফেললো। যারা মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল ছাত্র-জনতা। এখন এ অধিকার আমাদের সবার কাছে আসতে হবে। সে অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থায় ছিল, সংবিধান তাকে অধিকার দেবে এবং রাষ্ট্র সে অধিকার নিশ্চিত করবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। যে অধিকার কেড়ে নেবে, তাকে যেন সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেওয়া যায়। এটিই স্বপ্ন।’
তিনি বলেন, ‘সেটাকে কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা সবার সঙ্গে আলাপ করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে আমাদের রূপরেখা দেবে। তখন আমাদের পালা, আমরা যারা এখানে বসে আছি। দেশের সবার পালা। তারা যে রূপরেখা দেবে, তার মধ্যে আপনারা কোনটা চান, কোনটা চান না, তারা দিলো বলেই আমরা মেনে নিলাম তা না। সবার কাছে ফিরে আসতে হবে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘যেগুলো আপনারা চান সেগুলো বাস্তবায়ন করার নামই হলো সংস্কার। দেশকে পাল্টে ফেলার যে সুযোগ সৃষ্টি হলো, এটা যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়ে যায়, এটা হাত ছাড়া হতে দিয়েন না। কারণ একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে এটা আর কোনও দিন ফিরে আসবে না। অপূর্ব এক সুযোগ ছাত্র-জনতা আমাদের হাতে দিয়েছে। আমাদের হাতে আলাদিনের প্রদীপ দিয়ে দিয়েছে। আমরা যা চাই তাই করতে পারি। স্বপ্নগুলোকে একত্র করেন। ছোটখাটো বিষয়ের মধ্যে থাইকেন না। বড় বিষয়ের দিকে আসেন। কাঠামো তৈরি করে দিলে, তারপরে কে কী পেলো না পেলো, তার তো হিসাবই নেই, পাবো বলেই তো সব কিছু করছি।’
তিনি বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ বঞ্চিত ছিল। সেই কাহিনি বলতে গেলে সাত খণ্ড রামায়নের মতো শেষ হবে না। এত রকমের অত্যাচার-অবিচার দেশে হয়েছে। সেগুলো লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। তার পেছনে পড়ে থাকলে দেশটাকে শেষ করে ফেলবে। আপনারা নতুন বাংলাদেশের জন্য তৈরি হোন। এটার পেছনে থাকুক। জোর গলায় বলুন। ভয়ে বলবেন না। আপনি দেশের নাগরিক। নির্ভয়ে উচ্চকণ্ঠে বলুন। এই সুযোগ গ্রহণ করুন। সেটি প্রতিষ্ঠিত করুন। যেন আমরা যেকোনও জায়গায়, যেকোনও সময় উৎসব, দুর্গাপূজা যেমন ইচ্ছা তেমন করে করবো। আমরা কারও বিশেষ সেবা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো না। সেটিই আমাদের স্বপ্ন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। এটা কঠিন কাজ, সহজ কাজ না। কঠিন কাজ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করতে পেরেছে। এই কঠিন কাজটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সমাধা করতে পেরেছে, সবাই মিলে কাজ করলে যে সফলতা পাওয়া যায়, সেটা তারা প্রমাণ করেছে। তারা কষ্ট করার কারণে আমরা ছুটি উপভোগ করতে পারছি। তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে দুর্গাপূজা করছি। তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারি খুব শিগগিরই। যেখানে তারাও ছুটি উপভোগ করবে। আমরাও ছুটি উপভোগ করবো। তাদের ছুটি বিসর্জন দিয়ে আমাদের আনন্দ করতে হবে না। এ অপরাধবোধ থেকে আমরা মুক্ত হয়ে যাবো। দেশের নাগরিক হিসেবে উৎসব পালন করবো। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না। এরকম রাষ্ট্র আমরা গঠন করবো। আমরা সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গঠন করতে পারি— যেটা দিয়ে দেশের মানুষ দুনিয়ার সামনে গর্ব করতে পারি।