বিচারিক ক্ষমতায় যা যা করতে পারবে সেনাবাহিনী

সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে ফৌজদারি কার্যবিধির সুনির্দিষ্ট ১৭টি ধারায় গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারের আদেশ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল, তল্লাশি, মুচলেকা নেওয়াসহ বিভিন্ন বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা। সাধারণ সময়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসামরিক প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুমোদন নিতে হয়। নতুন আদেশের ফলে সেনা কর্মকর্তাদের এসব সিদ্ধান্ত বা আদেশ দেওয়া ও বাস্তবায়নে কোনো বাধা থাকছে না।

মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সেনা কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে ৬০ দিনের জন্য এই ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১২(১) ও ১৭ ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। তারা একই কার্যবিধির সুনির্দিষ্ট ১৭টি ধারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রয়োগ করতে পারবেন। ধারাগুলো হলো— ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬ (২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় গত ১৯ জুলাই দেশে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেছিল ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। তিন দিন পর ৮ আগস্ট গঠন করা হয় নতুন সরকার। তবে সেনাবাহিনী তুলে নেওয়া হয়নি। বরং এখনো সেনাবাহিনী মাঠেই রয়েছে। প্রায় দুই মাস ধরে মাঠে থাকলেও এতদিন বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সেনা মোতায়েন করা ছিল। এবার সেনা কর্মকর্তাদের হাতেও দেওয়া হলো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা।

কোন ধারায় কী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা :
ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪ ও ৬৫ ধারায় রয়েছে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত বিধান। ৬৪ ধারা অনুযায়ী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তিনি নিজে অপরাধীকে গ্রেপ্তার  করতে পারেন বা কাউকে দিয়ে গ্রেফতার করাতে পারেন বা হেফাজতে রাখার ক্ষমতা পাবেন। অন্যদিকে ৬৫ ধারা অনুযায়ী, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন বা অন্য কাউকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিতে পারেন।

এদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৩ ও ৮৪ ধারায় রয়েছে নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিলের বিষয়টি। আইন অনুযায়ী, এ ধরনের পরোয়ানা তামিল করতে হলে আদালত সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলে ওই এলাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা পুলিশ সুপার বা মহানগর এলাকায় পুলিশ কমিশনারকে সেটি তামিল করতে বলতে পারেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন নিয়ে কোনো পুলিশ কর্মকর্তাও গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করতে পারবেন। ৮৬ ধারায় গ্রেফতার ব্যক্তিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত করা হলে করণীয় বলা হয়েছে।

৯৫(২), ১০০ ও ১০৫ ধারা অনুযায়ী তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা পেয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা। এর মধ্যে ৯৫(২) ধারা অনুযায়ী, কোনো সন্দেহজনক ডক্যুমেন্ট, পার্সেল বা বস্তু তল্লাশি করা যাবে। ১০০ ধারায় বলা আছে, কেউ কোনো ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে আটক রাখলে যিনি বা যারা আটক রেখেছেন, তার বা তাদের বিরুদ্ধে তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করা যাবে। ১০৫ ধারা অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো স্থানে তার সামনে তল্লাশির আদেশ দিতে পারবেন।

জনসাধারণের শান্তি বা কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে— শান্তি রক্ষার স্বার্থে এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে ১০৭ ধারায়। ১০৯ ধারায় ভবঘুরে বা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ভালো আচরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা রাখবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ১১০ ধারায় অভ্যাসগত অপরাধীদের ভালো আচরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। অন্যদিকে ১২৬ ধারা অনুযায়ী জামিনদারকে তলব করে জামিন নিষ্পত্তি করতে পারবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

বিধি বহির্ভূত সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও সেখানে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭, ১২৮ ও ১৩০ নম্বর ধারায়। ১২৭ ধারা অনুযায়ী, বেআইনি কোনো সমাবেশ কিংবা জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করার মতো পাঁচ বা তার বেশি ব্যক্তির কোনো সমাবেশ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারবেন। ১২৮ ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে বেসামরিক বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবেন। সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার বা হেফাজতেও রাখতে পারবেন। ১৩০ ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে সামরিক বাহিনীর সহায়তাও নেওয়া যাবে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩৩ ও ১৪২ ধারায় বিভিন্ন ধরনের উপদ্রব থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। এ ক্ষেত্রে ১৩৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ধরনের উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিশেষ ধরনের বিধিনিষেধ জারি করতে পারবেন। ১৪২ ধারা অনুযায়ী, এ ধরনের কোনো ঘটনায় আসন্ন ক্ষতি বা জনসাধারণের বড় ধরনের আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তা প্রতিরোধ করতে বিশেষ আদেশ জারি করতে পারবেন।

এর বাইরে যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন। এই আইন অনুযায়ী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার উপস্থিতিতে বা সামনে সংঘটিত অপরাধ আমলে নিতে পারেন। অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি পেলে তাকে সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য কারাদণ্ডও দিতে পারেন।