পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে সিডিএ কার্যালয় ঘেরাও

নগরীর আসকরদীঘি পাড়ে গ্রিনলেজ ব্যাংক পাহাড় কেটে ১৭ তলা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে সিডিএ কার্যালয় ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

 বৃহস্পতিবার ( ১ আগস্ট ) দুপুরে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচীতে থেকে সিডিএ চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।

 এ সময় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনূস বলেন,পাহাড় কাটা মানবজাতির সাথে শত্রুতার সমান। আল্লাহ প্রদত্ত এই প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শক্ত হাতে দমন করতে কখনো পিছপা হবে না। প্রয়োজনে আমাদের কোন কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, এখন যদি তাদের প্ল্যান বাতিল করে দিই, তাহলে হাইকোর্টে গিয়ে আমাদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসবে। সেই সুযোগ আমি দিবো না। এরমধ্যে মোবাইল কোর্ট পাঠিয়ে তাদের টিনের ঘেরা তুলে দিবো। পাহাড় কাটার বিষয়ে নজরদারিতে রেখে প্রয়োজনে মামলা করা হবে। তবে সেক্ষেত্রে পরিবেশে অধিদপ্তরের সহযোগিতা লাগবে।

সিডিএ চেয়ারম্যান আরো বলেন, আমি দায়িত্ব থাকাকালে চট্টগ্রামে একটি পাহাড়ও কাটা যাবে না। তারা জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমকে ম্যানেজ করে পাহাড় শ্রেনীকে বাড়ি ভিটি ভূমি করে এনে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিরুপায় করে দেয়। গ্রিনলেজ পাহাড় কাটার জন্য তারা দূর্গ করেছে আমরা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সেই দূর্গ ভেঙে কাজ বন্ধ করে দিব।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজিত অবস্থান ধর্মঘটে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নারী সংগঠক নুরজাহান খান, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম ও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি  চৌধুরী ফরিদ, সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান, রাজনীতিবিদ সংগঠক মিঠুল দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার চট্টগ্রাম সমন্বয়ক মনিরা পারভিন রুবা ও বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার সিঞ্চন ভোমিক।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম সিনিয়র সহ সভাপতি চৌধুরী ফরিদ বলেন, রাতের আধারে লাইনদিয়ে ট্রাক লাগিয়ে গ্রিনলেজ পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রশাসনের সহযোগিতা না থাকলে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে চল্লিশ ফুট উচু ঘেরাও দিয়ে পাহাড় ধ্বংস সাহস কেউ করবে না। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাহাড় রক্ষায় সংশ্লিষ্ট আইন ও হাইকোর্টের আদেশ মেনে পাহাড় নিধন বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি।

সাংবাদিক ও পরিবেশ সংগঠক আলীউর রহমান বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষায় ২০১১ সালে বেলা দায়েরকৃত রিট মামলায় পাহাড় কাটা বন্ধে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সেই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। বেলা থেকে ইতোমধ্যে লিগ্যাল নোটি দেয়া হয়েছে। তারপরও গ্রিনলেজ পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। সিডিএ, চসিক, পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে রিট মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাহাড় কাটা বন্ধে শিঘ্রই এই আদালতে গিয়ে হাইকোর্টের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর বিষয়ে জবাবদিহি করার নির্দেশনা চাওয়া হবে।

অনুষ্ঠিত কর্মসূচীতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেলা’র কর্মকতা ফারমিন এলাহি, সাংবাদিক ও শিল্পী আহসান হাবিবুল আলম, মোহাম্মদ শাকিল প্রমুখ।

প্রসঙ্গত; নগরের আসকারদিঘি পাড় এলাকায় এসএস খালেদ রোডে গ্রিনলেজ ব্যাংক পাহাড় কেটে ১৭ তলার তিনটি ভবন নির্মাণ করছে ‘স্বপ্নীল ফ্যামিলি ওনার্স নামের একটি ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। পরিবেশ ছাড়পত্রের অনুমতি ছাড়া কাটা হয়েছিল ২৮ হাজার বর্গফুট পাহাড়। ১ জুন ২০২০ সালে ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রোর উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক। অভিযানে পাহাড়ের কাটা অংশ আগের অবস্থায় ভরাট করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে একই বছর ৭ মার্চ  ভবন নির্মাণের জন্য নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন পায়।

উল্লেখ্য, ১৯৮৫—৮৭ সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের করা সার্ভে বা বিএস রেকর্ডে ৫০২ নম্বর রহমতগঞ্জ মৌজার ৫০২ নম্বর দাগ বাড়ি হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। এ দাগটি ষাটের দশকে করা আরএস জরিপে চারটি দাগে রেকর্ড হয়েছিল। দাগ নম্বরগুলো ছিল ১৭৯(অংশ), ১৮০/২২৮(অংশ), ১৮০/২৩১(অংশ) ও ২৩২(অংশ)। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুম থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৭৯ দাগ নম্বরটি পাহাড়ের ঢাল, ১৮০ দাগ নম্বরটি বাংলো, ১৮০/২২৮ দাগ নম্বরটি টিলা, ১৮০/২৩১ দাগ নম্বরটি পাহাড়ের ঢাল এবং ২৩২ দাগ নম্বরটি ফুলের বাগান হিসেবে ভূমির শ্রেণি উল্লেখ রয়েছে। আরএস রেকর্ড অনুযায়ী পাহাড়ের ওপরে একটি বাংলো ছিল। আর বাকি এলাকা পাহাড়, পাহাড়ের ঢাল ও ফুলের বাগান।

২০২০ সালের জুনে উপরোক্ত পাহাড় ও ঢালু ফুলের বাগান কেটে সমতল করার প্রমান পায় পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া ২৮ হাজার বর্গফুট পাহাড় কাটার জন্য সে সময় ২৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি ওই অভিযানে পাহাড়ের কাটা অংশ আগের অবস্থায় ভরাট করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরিবেশ অধিদপ্তর ফাইন করা সত্ত্বেও প্রতিটি ১৭তলার তিনটি ভবন নির্মাণের নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন পায় ২০২১ সালের ৭ মার্চ। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের অনুমোদন পায় ২০২২ সালের ১১ মে এবং বিশেষ প্রকল্পের ছাড়পত্র পায় ২০২৩ সালের ৫ মার্চ। সর্বশেষ ইমারত নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে তিনটি বেইজমেন্ট ও ১৪তলা (পাহাড়ে বেইজমেন্ট হয় না, বাস্তবে তিনটি পার্কিং ফ্লোর ও ১৪তলা আবাসিক মোট ১৭তলা) ভবনের অনুমোদন নেওয়া হয় ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল। নগর উন্নয়ন কমিটি ৭টি, বিশেষ কমিটি ২৫টি, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র কমিটি ২২টি, ইমারত নির্মাণ কমিটি ৩২টি শর্ত দিয়েছিল ভবনগুলো নির্মাণে। যদিও চার কমিটির এই ৮৬ শর্তের অনেকগুলোরই একটির সঙ্গে আরেকটির মিল আছে।