নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হারিয়ে যাওয়া একটিসহ কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দায়ে দু’টি মামলা দায়ের করেছে দুদক-চট্টগ্রাম। এর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া একটিসহ নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ৫০ হাজার মানুষকে ভোটার করা নিয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) শরীফ উদ্দিন। অন্যদিকে এক রোহিঙ্গা দম্পতিকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় আলাদা আরেকটি মামলা করেছেন একই কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত। দুই মামলায় মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুন) চট্টগ্রামের দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় এই দুই মামলা দায়ের করে।
মামলার আসামিরা হলেন- চট্টগ্রাম জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা ও বর্তমানে ইসি সচিবালয়ের পরিচালক খোরশেদ আলম, রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম, অফিস সহায়ক রাসেল বড়ুয়া ও টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তফা ফারুক।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কাজে ব্যবহার করতে মীরসরাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের জন্য Dell Latitude 630, Service Tag Number-GYSPSIS- 4214 নম্বরের একটি ল্যাপটপসহ বেশকিছু মালামাল চালানপত্র ও প্রাপ্তি স্বীকার পত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করেন মোস্তফা ফারুক। তিনি সেটি মীরসরাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীতে আবার সেই ল্যাপটপ মীরসরাই থেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তৎকালীন অফিস সহায়ক ও বর্তমানে রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান সেটি গ্রহণ করে অন্য উপজেলায় পাঠান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর ল্যাপটপটির হদিস জানতে পারেননি নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ল্যাপটপের হদিস না মেলার বিষয়টি মাহফুজুর রহমান ও রাসেল বড়ুয়া ঊর্ধ্বতনদের অবহিত না করে এড়িয়ে যান। তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম সেটি অবহিত হলেও উদ্ধারের কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ল্যাপটপটির বিষয়ে থানায় কোনো জিডি কিংবা মামলাও তখন হয়নি। অথচ ২০১২ সালে নির্বাচন কমিশনের আরও সাতটি ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রাঙামাটির কোতোয়ালি ও কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
২০১৯ সালে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা নিয়ে জালিয়াতির বিষয় গণমাধ্যমে উঠে এলে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় উদ্ধায় হয় ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নাল আবেদীনের কাছে থাকা একটি ল্যাপটপ। নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটিই সেই ল্যাপটপ কি না- তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, নির্বাচন কমিশনেরই কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জন লোককে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে খোয়া যাওয়া ওই ল্যাপটপটিও ব্যবহার হয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে কক্সবাজারের টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলমের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) পাওয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে খোরশেদ আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কিন্তু খোরশেদ আলম চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় যে ল্যাপটপটি হারিয়ে গিয়েছিল, সেই বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি তদন্তের সময় সেটি ধর্তব্যেই আনেননি।
দুদক বলছে, এ ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাঁচাতে খোরশেদ আলম নিজ দায়িত্ব লঙ্ঘন করেন। অবৈধ যোগসাজশের ভিত্তিতে পক্ষাবলম্বন করেন। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১০, ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় মামলাটি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও মামলার বাদি শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কার্যালয় থেকে কয়েকটি ল্যাপটপ পেয়েছি। যেগুলোর আইডি নম্বর একাধিকবার পরিবর্তন করা। এ অবস্থায় কোন ল্যাপটপটি হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা বের করার জন্য আরও তদন্ত প্রয়োজন। তবে আমরা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি যে, ওই ল্যাপটপসহ আরও কয়েকটি ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন বাঙালি ছাড়া প্রায় সবাই রোহিঙ্গা। আরও রোহিঙ্গা অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না- সেটার জন্য বিস্তারিত অনুসন্ধান প্রয়োজন।’
এদিকে রোহিঙ্গা দম্পতিকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মামলায় আসামি করা হয়েছে সাতজনকে। এরা হলেন- নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন ও নূর আহম্মদ, সাবেক ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নঈম উদ্দিন, ওবাইদুল্লাহ, শামসুর রহমান, ফয়াজ উল্লাহ ও তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ফয়াজ উল্লাহ ও তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন রোহিঙ্গা। আসামি জয়নাল আবেদীন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার নির্বাচন কার্যালয়ে বসে তাদের ডেটা তৈরি করে। আর নঈম উদ্দিন কক্সবাজারে বসে সেগুলো অবৈধভাবে কক্সবাজার সদর উপজেলা কার্যালয় থেকে সার্ভারে আপলোড দেন।
অপর আসামিদের বিরুদ্ধে এজাহারে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন থেকে ফয়াজ উল্লাহ ও তা স্ত্রীর নামে বরাদ্দ করা ফরমগুলো জয়নাল নিজ বাসায় মজুদ রেখেছিলেন। জয়নালের ভগ্নীপতি নূর আহম্মদ ও তার স্ত্রী মিলে ফরমগুলো পূরণ করেন। অপর দুই আসামি ওবাইদুল্লাহ ও শামসুর রহমান রোহিঙ্গা দম্পতিকে কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে জয়নালের কাছে নিয়ে আসেন।