লাখো লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় চিরনিদ্রায় জুলাই বিপ্লবী শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি

দেশের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা ও আধিপত্যবাদবিরোধী প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি। শনিবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে তাকে দাফন করা হয়।

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সদস্য সচিব আখতার হোসেন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

         

এর আগে শনিবার দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক।

জানাজায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ।

জানাজার আগে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। হাদির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবু বকর সিদ্দিক তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করেন। এ সময় শোকাহত জনতার মাঝে কান্নার রোল পড়ে যায়।

জানাজার আগে সংসদ ভবন প্লাজার সামনের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেকেই মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সড়কে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন। জানাজা শেষে অ্যাম্বুলেন্সযোগে তার মরদেহ সমাধিস্থলে নেওয়া হয়।

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শরিফ ওসমান বিন হাদি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ গড়ে তুলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় আসেন। বিভিন্ন টেলিভিশন টক শোতে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তার যুক্তিতর্ক ও বক্তব্যের একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তিনি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসন থেকে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রায় এক মাস আগে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন হাদি। গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাকে ফোন ও মেসেজ করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাবেন না বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।

১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় প্রচারে গেলে মোটরসাইকেলে আসা দুই সন্ত্রাসী তাকে গুলি করে। রিকশায় থাকা অবস্থায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হলে তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে সরকারিভাবে তাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। চিকিৎসকদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার রাতে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখকে মূল সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

মৃত্যুর পর ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তার মরদেহ দেশে আনা হয় এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়।

শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।