সামর্থবান মানুষের টাকায় কেনা ১১টি গরু ও ছাগল। কোরবানী দিয়ে সেই মাংস আবার সযত্নে পৌঁছে দেয়া হয় গ্রামে গ্রামে কোরবানী দিতে অক্ষম মানুষদের ঘরে ঘরে। ‘সবার সাথে কোরবানী ঈদ’ এই শ্লোগানে একটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের ৪৭৭ পরিবারে কোরবানী ঈদের আনন্দ পৌঁছে দিয়েছে একদল উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবী যুবক। এমন ব্যতিক্রমী আয়োজনে পুরো ইউনিয়নে সাড়া ফেলেছে নতুন একটি সামাজিক সংগঠন মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার এক সমৃদ্ধ ইউনিয়ন মুরাদপুরে কয়েক মাস আগে যাত্রা শুরু করে মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস নামের একটি সংগঠন। ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) সীতাকুণ্ডের মুরাদপুরে এমন ভিন্ন এক কোরবানী ঈদ পালন করেছে ’সবার সাথে কোরবানী ঈদ’ শিরোনামে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী এমআর সিদ্দিকী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক প্রফেসর নজির আহমদ, সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী এলকে সিদ্দিকীসহ অনেক জ্ঞানী-গুনির জন্ম দেয়া মুরাদপুরের কিছু তরুণ-যুবার চিন্তার ফসল মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস। কর্মসূত্রে যার উদ্যোক্তাদের অনেকে থাকেন পৃথিবীর নানা দেশে। কিন্তু তাদের মন যেন পড়ে আছে নিজ জন্মভিটা মুরাদপুরে।
ফেসবুক গ্রুপ শেকড়ের টানে’র মাধ্যমে মুরাদপুর ইউনিয়নের প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের কানেক্টিভিটি তৈরী হয় চলতি বছরের মার্চে। আর মে মাসের শুরুর দিকে শেকড়ের টানে গ্রুপ এলাকায় কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনকে সামনে রেখে গঠিত হয়, সমাজ উন্নয়নমূলক সংগঠন মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস-এর। এই ক’মাসে নানা সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কাজ সফলভাবে শেষ করে এই সংগঠন।
কয়েক মাস বয়সী এই সংগঠনের সবচে বড় উদ্যোগ ‘সবার সাথে কোরবানির ঈদ’ উদযাপন প্রকল্প। ‘করি সবাই মিলে’ ফেসবুক গ্রুপের আহ্বানে দেশ-বিদেশে থাকা মুরাদপুরের সন্তানদের অনেকে সাড়া দেন এই মানবিক উদ্যোগে।
এই কোরবানী কর্মসূচিতে দেশ-বিদেশ থেকে শরীক হয়েছেন অনেকে। অনেকে শরীক হন ৩ ভাগ পর্যন্ত। তাদের পাঠানো টাকায় কেনা হয় ৬টি গরু ও ৫টি ছাগল। ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার মুরাদপুর শহীদ ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা উচ্চ বিদ্যালয় অঙ্গনে কোরবানী দেয়া হয় ১১টি গরু ও ছাগল।
একদল স্বেচ্ছাসেবী যুবকের অক্লান্ত শ্রমে মাংস কাটাসহ সব প্রক্রিয়া শেষে দৃষ্টি নন্দন প্যাকেটে করে পাঠানো হয় আগে থেকে তালিকা করা মুরাদপুর ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের ১৫টি গ্রামে। পর্যাপ্ত মাংস পেয়ে এসব গ্রামের ৪৭৭ পরিবারে যেন ওই দিন বয়ে যায় কোরবানী ঈদের প্রকৃত আনন্দ।
এমন আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস-এর পলিসি নির্ধারণ কিমিটির সদস্য ও আবুধাবী প্রবাসী আখতারুন্নবী শাহীন জানান, এলাকার যে সব ভাই-বোনেরা কোরবানী দিতে অসমর্থ, তাদের সাথে ঈদের আনন্দ শেয়ার করতে ইসলামী শিক্ষার আলোকে তাদের এই উদ্যোগ। যা বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বিত্তশালীরা মুসলিমরা করে থাকেন। তিনি জানান, মউস’র উদ্যোগে শরীক হয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ তিন ভাগ পর্যন্ত কোরাবানীর অর্থ দিয়েছেন। সর্বনিম্ন পাঁচশত টাকা দিয়েও এমন উদ্যোগে নিজেকে শরীক করেছেন কেউ কেউ। আখতারুন্নবী শাহীন বলেন, মউস চেষ্টা করেছে- কোরবানী হিসেবে সহায়তার অর্থ সঠিকভাবে যাতে ব্যয় হয়। শরীয়া সম্মতভাবে যাতে কোরবানী সম্পন্ন করে শরীকদারের ওয়াজিবটা যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যায়। আর মাংস বিলি-বন্টনেও নিশ্চিত করার চেষ্টা ছিল প্রকৃত হকদাররা যেন তা পান।
আর এজন্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতামত নেয়ার কথা জানান, মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস-এর আরেক উদ্যোক্তা ও পলিসি নির্ধারণ কমিটির সদস্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড-এর অবসরপ্রাপ্ত জিএম (অর্থ) মো. আবু জাফর ভূইয়া।
মুরাদপুর উন্নয়ন সোসাইটি-মউস-এর এমন আয়োজনে যারা সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন এবং স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, পলিসি নির্ধারণ কমিটির আরেক সদস্য কর্নেল ফখরুদ্দীন ভূঁইয়া। প্রথমবারের আয়োজন থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর কোরবানী ঈদ পুরো ইউনিয়নের মানুষের জন্য যেন ‘খুশীর ঈদ’ হয় এমন কিছু করার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
উল্লেখ, যাত্রা শুরুর তিন মাসের মধ্যেই ব্যতিক্রমী বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ণ করে সংগঠনটি। এর মধ্যে আছে দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প-দাদুপ ১,২,৩,৪ এর মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ৩৩ টি হতদরিদ্র পরিবারকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে সেলাই মেশিন, দুইটি করে ছাগল, হাঁস মুরগীর খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া হয়। লাইটিং আপ মুরাদপুর ইউনিয়ন প্রজেক্টের মাধ্যমে পুরো ইউনিয়নকে স্ট্রিট লাইটিং এর আওতায় আনার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
ইউনিয়নের সবগুলো চায়ের দোকানে উন্নতমানের কাপ-পিরিচ উপহার দেয়া এবং সর্বশেষ গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বাবা-চাচাদের লাঠি উপহার দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব কার্যক্রম বেশ প্রসংসিত হচ্ছে পুরো ইউনিয়নজুড়ে।